আজ থেকে চার হাজার বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ লক্ষ। যা আমাদের আজকের ঢাকা শহরের জনসংখ্যা থেকেও অনেক কম। খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ সালে অর্থাৎ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি। দ্বিতীয় শতকে এসে দ্বিগুণ হয়েছে; অর্থাৎ ২০ কোটি। আমাদের আজকের ২০০০ সালে এসে হয়েছে ৭০০ কোটি। যে কোন প্রাণীর তুলনায় এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধিহার যে পরিমাণ ঘনবসতি, নগরায়ন আর সভ্যতার জগাখিচুড়ি ঘটিয়েছে তাতে পৃথিবী জুড়ে রোগবালাই ছড়িয়ে যাওয়াটাই বেশ স্বাভাবিক।

যখন থেকে মানুষ জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিতে শিখলো তখন থেকেই মানব সভ্যতায় বিরাট এক আপদের সূচনা হলো। তার আগে ভৌগলিকভাবে আলাদা মানুষের সমাজগুলির রোগবালাই ভিন্ন ভিন্ন ছিলো। যেমন, ইউরোপের রোগবালাই ছিল এক রকম আবার আমেরিকা মহাদেশের রোগের ধরণ ছিলো ভিন্ন রকম। ১৪৯৩ সালে আমেরিকা মহাদেশে প্রথম সোয়াইন ফ্লু বা শুকরবাহিত সর্দিজ্বর মহামারি রূপে দেখা দেয় তা দখলদার কলম্বাসের জাহাজে করে যেই শুকরেরা আমেরিকায় এসেছিলো, সেখান থেকেই এই মহামারি সূচনা হয় যা ইতিহাসে নিউ ওয়ার্ল্ড মহামারি বলে পরিচিত। আবার ১৫১৮ সালে আরাওয়াক ও হিসপানিওয়ালার প্রায় অর্ধেক মানুষ সাফ হয়ে যায় দখলদারদের আগমনের সাথে গুটিবসন্ত চলে আসায়।

ভিনদেশি রোগের সংক্রমণের কারণে আজকের দক্ষিণ আমেরিকাকেও চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। স্পেনীয় দখলদার কর্তেসের মাধ্যমে গুটিবসন্ত মেক্সিকোতে ছড়ায় ১৫২১ সালে। সাথে করে গুটিবসন্ত নিয়ে আসায় সেই সভ্যতার ৩ লাখ মানুষ মারা যায় অচিরেই। অন্যদিকে দশ বছর পরে আরেক স্পেনীয় দখলদার পিজারো ইনকাদের দখল করতে গেলে একই জিনিস ঘটে। আসলে গুটিবসন্ত তার অভিযানের আগেভাগেই পথ চলছিলো পেরুর দিকে। ফলে নিজেদের হাতে হত্যা করে হাত নোংরা করার কাজটা করতে হয় নি তাকে যা আগেভাগেই করে দিয়েছিলো এই রোগ।

এরপর একে একে আসে সর্দিজ্বর, হাম, ও টাইফাস জ্বরের মহামারী। অনেক বছর পরে মেক্সিকো এবং আন্দিজ কিছুটা সামলে নিলেও ব্রাজিলের জনসংখ্যা প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়। ফলে ভয়াবহ জনসংখ্যার অভাব দেখা দেয়। জনসংখ্যার এই ঘাটতি পূরণে স্পেনীয় ও পর্তুগিজরা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে ধরে নিয়ে আসে দাস। এই দাসরা তাদের সাথে করে আমেরিকায় নিয়ে আসে ম্যালেরিয়া ওপীতজ্বর। আফ্রিকা মহাদেশ ম্যালেরিয়ার আঁতুড়ঘর হওয়াতে সেখানকার বেশ কিছু মানুষ প্রাকৃতিকভাবে হয়ে উঠেছিল ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী। তাদের লোহিত রক্তকোষে একধরনের পরিবর্তন এসেছিলো যাকে সিকেল সেল এনেমিয়া বলে। এর ফলে যেটা হয়েছে তা হলো ইউরোপীয়রা আরও বেশি বেশি আফ্রিকার লোকদেরকে দাস হিসেবে রাখা শুরু করে। কারণ তাদের ম্যালেরিয়া হয় না। অন্যদিকে আমেরিকার মানুষজনের এরকম কোন জিনগত পরিব্যক্তি না থাকায় তারা খুব সহজেই ম্যালেরিয়ায় কাবু হয়। এই রোগের আদান প্রদান কিন্তু শুধু একপাক্ষিক ছিলো না। কলম্বাস যখন আমেরিকা থেকে ইউরোপে ফিরে গেলো, তখন সাথে করে নিয়ে গেলো এক ভয়াবহ রোগ। ১৪৯৩-৯৪ তে ফরাসি-স্পেনীয় যুদ্ধে নেপলসে ছড়ায় এই বীভৎস রোগ। সেখান থেকে ছড়ায় সারা ইউরোপে। এ রোগে প্রথমে যৌনাঙ্গে ঘা দিয়ে উপসর্গ দেখা দেয়। তারপরে শরীরে বীজকুড়ি আসে এবং পঁচে যাওয়া শুরু করে, শেষ হয় একেবারে হাড়ের ক্ষয় দিয়ে। রোগটির নাম সিফিলিস। ইউরোপের বহু মানুষ এই অবিশ্বাস্যরকম বীভৎস রোগে ভুগেছে কলম্বাসের কারণে।

জবর দখল আর যুদ্ধের খেলায় পৃথিবীব্যাপী নানা রোগ ছড়িয়েছে সন্দেহ নেই। নিজেদের ছড়ানো রোগে নিজেরাই মরণ ফাঁদে পড়েছে এমন ইতিহাসও আছে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর ফরাসি সৈন্যদল যখন ১৮১২ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বরে রাশিয়া আক্রমণে মস্কো পর্যন্তই চলে গিয়েছিলো, তখন নেপোলিয়ন দেখতে পায় যে পুরো মস্কো শহর পরিত্যজ্য নগরী। কোন জনমানব নেই পুরো শহর শুধু খাঁ খাঁ করছে। পরের ৫ সপ্তাহে ফরাসি সৈন্যরা টাইফাস রোগের মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে পরে। ৬ লাখ সৈন্যের প্রায় সবাই মারা পড়ে সেই মহামারীতে।

রাশিয়ার টাইফাস মহামারীর দুইশত বছর পর করোনাভাইরাস আতঙ্ক: অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে সারা বিশ্বের একের পর এক শহর। এই মহামারিতে বড় বড় উন্নত দেশও খুবই হিমশিম খাচ্ছে। আজ এই ভাইরাস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, জড়বাদী, ভোগবাদি আর বিলাসের সমাজই আমরা তৈরি করেছি। সংকটময় মুহুর্তে বোঝা যায়, পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বাড়ি, গাড়ী একজন মানুষকে বাঁচাতে পারেনা। যেমন পারে- ঔষধ, খাবার আর পানি। আমরা যখন সকল মানবিক গুণাবলী হারাতে বসেছি, তখন এই ভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিল, স্বার্থসিদ্ধির বা নিজের উন্নতির জন্য বেপরোয়া প্রতিযোগিতাই জীবনের মূল উদ্দেশ্য নয়, জীবনের মূল উদ্দেশ্য মানুষ মানুষের পাশে থাকবে, মানুষ মানুষের কাছ থেকে সহানুভূতি পাবে, মানুষ মানুষকে রক্ষা করবে। আজ এই ভাইরাস থেকে আমরা যেন শিক্ষা নিতে পারি, নিজেদের শুধরাতে পারি। এটা পৃথিবীর শেষ নয়, বরং নতুন এক পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়

Post a Comment

Previous Post Next Post