মাহমুদ দারবিশ
ভূমিকা ও অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ
ভূমিকা ও অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ
[পরিচিতিঃ ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশের জন্ম ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ, গালিলি প্রদেশের আল বিরওয়া গ্রামে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ইসরাইলি সেনাবাহিনী তাদের গ্রাম দখল করে নিলে পরিবারের সাথে কোন রকমে প্রাণ রক্ষা করে তিনি পালিয়ে যান লেবাননে। উদ্বাস্তু হিসেবে সেখানেই কাটে তাঁর জীবনের পরবর্তী এক বছর। এরপর যখন তিনি বাবা-মা’র সাথে ইসরাইলে ফিরে আসেন তখন বিরওয়া নামে কোন গ্রামের অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে দায়ের আল আসাদ নামক অন্য একটি গ্রামে অভ্যন্তরিন উদ্বাস্তু হিসেবেই কোন রকমে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে হয় তাদের । পরে মাধ্যমিক স্কুলের পাট চুকিয়ে তিনি চলে যান হাইফাতে এবং সেখানে পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতা।
মাহমুদ দারবিশের রাজনৈতিক জীবনের শুরু ১৯৬১ সালে, ইসরাইলি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেবার মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে পাকাপোক্তভাবে ইসরাইল ছেড়ে যাবার আগ পর্যন্ত এই দলের সাথেই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পড়াশুনা করবার পর ১৯৭১ সালে তিনি চলে আসেন মিশরের রাজধানী কায়রোতে এবং কর্মজীবন শুরু করেন আল-আহরাম পত্রিকাতে। এর দুই বছর পর ১৯৭৩-এ তিনি লেবাননের রাজধানী বৈরুতে গিয়ে যোগ দেন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-তে। যোগ দেবার পরপরই তিনি ফিলিস্তিন রিসার্স সেন্টার-এর পরিচালক পদে নিযুক্ত হন এবং দায়িত্ব পান শু’উন ফিলিস্তিনিয়া (চধষরংঃরহরধহ অভভধরৎং) নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনার। মাহমুদ দারবিশ তাঁর কর্মযোগ্যতায় ১৯৮৭ সালে পিএলও’র কার্যনির্বাহি পর্ষদের সদস্য নির্বাচিত হলেও ১৯৯৩ সালে ইসরাইলের সাথে বিতর্কিত অসলো শান্তিচুক্তির প্রতিবাদে সে পদ থেকে ইস্তফা দেন। ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি “দৃঢ় ও স্বচ্ছ” নীতি অবলম্বনের পক্ষপাতি ছিলেন।
কবি মাহমুদ দারবিশ তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ডানাহীন পাখি (আসাফির বিলা আজনিহা) প্রকাশ করেন ১৯৬০ সালে, ১৯ বছর বয়সে। এই গ্রন্থে প্রেমের কবিতা প্রাধান্য পেলেও ১৯৬৪ তে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ জলপাই পাতা (আওরাক আল যায়তুন) তাকে “ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের কবি” খ্যাতি এনে দেয়। প্রতিরোধের কাব্য নামে আরবি কাব্য ভুবনে যে নতুন ধারার সূচনা হয়েছে মাহমুদ দারবিশ তার অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী কবি। মাহমুদ দারবিশের কাব্য চিন্তা আবদ্ আল ওয়াহাব আল বায়াতি, র্যাঁবো, জিন্সবার্গ ও ইয়াহুদা অ্যামেচাই দ্বারা প্রভাবিত।
মাহমুদ দারবিশের প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা ৩০ এবং প্রবন্ধের গ্রন্থ ৮টি। তাঁর বিভিন্ন কাব্য গ্রন্থ বিশ্বের প্রায় ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাব্য গ্রন্থ হলোঃ ফিলিস্তিনি প্রেমিক (আশিক মিন ফিলাস্তিন, ১৯৬৬), রাতের সমাপ্তি (আখের আল লাইল, ১৯৬৭), আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকে ভালবাসি না (উহিব্বুখি আও লা উহিব্বুখি, ১৯৭২), বৈরুত গাথা (কাসিদাত বৈরুত, ১৯৮২) মানচিত্রের শিকার (১৯৮৪) এবং বালু ও অন্যান্য কবিতা (১৯৮৬)। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া নিয়ে মাহমুদ দারবিশের সাথে ছলনা করা হলেও তিনি ভূষিত হয়েছিলেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কারে। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলো হলোঃ দি লোটাস প্রাইজ (১৯৬৯), লেনিন পিস প্রাইজ (১৯৮৩), দি লানান ফাউন্ডেশন প্রাইজ (২০০১), প্রিন্স ক্লাউস অ্যাওয়ার্ড (২০০৪) এবং স্ট্রাগা পোয়েট্রি ইভেনিং অ্যাওয়ার্ড (২০০৭)।
ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ ২০০৮ এর ৯ আগষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে হৃৎপিন্ডে অস্রোপচার জনিত জটিলতায় মৃত্যু বরণ করেন। ১৯৯৭ সালে আল যাদিদ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন নূরী আল জারাহ । ]
নূরী আল জারাহ: এই অপ্রত্যাশিত ক্ষণস্থায়ী ভ্রমণে আপনার গ্রামের প্রথম সড়কে পা দেবার পর আপনার পরিচয় কী ছিল? এই স্বপ্নের মত ভ্রমণের পর, কে আপনি? এই ভ্রমণের আগে আপনি কে ছিলেন? ভ্রমণের পর কিছু বদলেছে কি?
মাহমুদ দারবিশ: আমি এখনো বিস্মিত হচ্ছি, এই ভ্রমণের আগে আমি যা ছিলাম এখনো কি তাই আছি! নাকি কিছু একটা ঘটেছে। নিঃসন্দেহে কিছু একটা ঘটেছে। কে আমি? এই ক্ষণস্থায়ী ভ্রমণ আমাকে তাদের কাছেই নিয়ে গিয়েছিল যাদের সাথে আমি ৫০ বছর আগে ছিলাম। এই ভ্রমণ আমাকে এক খেলারত শিশুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল, যে ফুলের বাগানে ছুটোছুটি করতো, দু’ হাতে ইচ্ছেমত ফুল ছিড়তো আর তার জীবনের প্রথম প্রশ্নগুলো ছুড়ে মারতো। আমি এখনো বহুকাল আগের এই শিশুটিকে ফিরে পাবার পরমানন্দের যন্ত্রণার মধ্যে আছি। হ্যাঁ, আগে যা ছিলাম এবং ক্রমাগত যা হয়ে চলছি, আমি এখনো তাই আছি।
নূরী আল জারাহ: রাস্তার দু’ পাশে যে মানুষগুলো ফুল আর আবেগ নিয়ে আপনার দিকে তাকিয়েছিল তারা কোন মাহমুদকে খুঁজছিল? গ্রামের অসংখ্য মানুষের সাথে আপনি যখন বসে কথা বলছিলেন তখন আপনি কোন মাহমুদ ছিলেন? ‘লিখে রাখো, আমি একজন আরব’ সেই মাহমুদ? নাকি ‘তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে ভালবাসি না’ কিংবা ‘ওহ, কি চমৎকার বৃষ্টি’র মাহমুদ?
মাহমুদ দারবিশ: আমি মনেকরি, আমার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির উৎসগুলো ছিল মিশ্র। একেক জন একেক মাহমুদকে খুঁজে নিচ্ছিল। কিন্তু যখন লক্ষ্য করলাম তাদের মধ্যে অনেকেই একজন প্রতীক মাহমুদকে খুঁজছে আমি তখন যথেষ্ট ক্লান্ত বোধ করেছিলাম। আমার এই ক্লান্তির কারণ আমি নিজেকে প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইনা। তবে অন্য একটি কারণে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। কেউ কেউ সেই ছোট্ট মাহমুদকে খুঁজে ফিরছিল, যাকে তারা চিনতো; যে একদিন তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল; যার যৌবনকে তারা প্রত্যক্ষ করেছিল; যার কন্ঠস্বর তারা শ্রবণ করেছিল।
মাহমুদ দারবিশ: আমি এখনো বিস্মিত হচ্ছি, এই ভ্রমণের আগে আমি যা ছিলাম এখনো কি তাই আছি! নাকি কিছু একটা ঘটেছে। নিঃসন্দেহে কিছু একটা ঘটেছে। কে আমি? এই ক্ষণস্থায়ী ভ্রমণ আমাকে তাদের কাছেই নিয়ে গিয়েছিল যাদের সাথে আমি ৫০ বছর আগে ছিলাম। এই ভ্রমণ আমাকে এক খেলারত শিশুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল, যে ফুলের বাগানে ছুটোছুটি করতো, দু’ হাতে ইচ্ছেমত ফুল ছিড়তো আর তার জীবনের প্রথম প্রশ্নগুলো ছুড়ে মারতো। আমি এখনো বহুকাল আগের এই শিশুটিকে ফিরে পাবার পরমানন্দের যন্ত্রণার মধ্যে আছি। হ্যাঁ, আগে যা ছিলাম এবং ক্রমাগত যা হয়ে চলছি, আমি এখনো তাই আছি।
নূরী আল জারাহ: রাস্তার দু’ পাশে যে মানুষগুলো ফুল আর আবেগ নিয়ে আপনার দিকে তাকিয়েছিল তারা কোন মাহমুদকে খুঁজছিল? গ্রামের অসংখ্য মানুষের সাথে আপনি যখন বসে কথা বলছিলেন তখন আপনি কোন মাহমুদ ছিলেন? ‘লিখে রাখো, আমি একজন আরব’ সেই মাহমুদ? নাকি ‘তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে ভালবাসি না’ কিংবা ‘ওহ, কি চমৎকার বৃষ্টি’র মাহমুদ?
মাহমুদ দারবিশ: আমি মনেকরি, আমার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির উৎসগুলো ছিল মিশ্র। একেক জন একেক মাহমুদকে খুঁজে নিচ্ছিল। কিন্তু যখন লক্ষ্য করলাম তাদের মধ্যে অনেকেই একজন প্রতীক মাহমুদকে খুঁজছে আমি তখন যথেষ্ট ক্লান্ত বোধ করেছিলাম। আমার এই ক্লান্তির কারণ আমি নিজেকে প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইনা। তবে অন্য একটি কারণে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। কেউ কেউ সেই ছোট্ট মাহমুদকে খুঁজে ফিরছিল, যাকে তারা চিনতো; যে একদিন তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল; যার যৌবনকে তারা প্রত্যক্ষ করেছিল; যার কন্ঠস্বর তারা শ্রবণ করেছিল।
নূরী আল জারাহ: কিন্তু আপনার এই প্রতীক হয়ে উঠাকে তো আপনি এড়িয়ে যেতে পারেন না। কারণ ঐসব মানুষদের জন্যে আপনি প্রতীক সৃষ্টি করেছেন এবং এখনো করে চলছেন। আপনার জীবনই জনগণের কাছে আপনাকে একটি সাংস্কৃতিক চেতনায় রূপান্তরিত করেছে। মূলত এ কারণেই আপনি উভয়-সঙ্কটে পরেছেন। বিষয়টিকে কি আপনি এভাবেই দেখেন?
মাহমুদ দারবিশ: দৃশ্যত মনে হয়, আমার প্রতীক হয়ে উঠাকে আমি এড়িয়ে যেতে পারিনা। কিন্তু জনগণের সাথে আমার সম্পর্ককে আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করি সেরকম না হবার চেষ্টাই আমি করে থাকি। আমি সেই ব্যক্তির আনন্দকে অনুভব করি যে কখনো দেশান্তরিত হয়নি। আমি উপলব্ধি করি, আমি কখনো দেশান্তরিত হইনি। যে সময় ও ভৌগলিক দুরত্ব আমাকে আমার পরিবার, বন্ধুজন ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল আমার কাছে তা সবসময়ই রূপক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কারণ আমার মন ও আত্মা সবসময় তাদের কাছেই পড়ে থাকতো। এমনকি আমি যখনই পৃথিবীর সুদূর কোন প্রান্তে ভ্রমণ করেছি সেখানেও আমার বক্তব্যের সূত্র হতো আমার স্বদেশ; আমার বক্তব্যের প্রথম শব্দগুলোই হতো আমার মাতৃভূমি সম্পর্কে, তখনো আমার হৃদয় পড়ে থাকতো ফিলিস্তিনে।
আমার পরিবার আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল এবং সম্ভবত তাদের ফিরে পাওয়া সন্তানকে তারা বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করছিল। কেউ আমার দেশত্যাগকে নিন্দা করেনি। কারণ, হয়তো তারা জানতো এবং অনুভব করতো আমি দেশত্যাগ করিনি। তারা তাদের কন্ঠস্বরকে শ্রবণ করছিল, যে কন্ঠস্বর তাদের মধ্য থেকেই উত্থিত হয়েছে এবং তার প্রথম বসন্তকে পরিত্যাগ না করেই দূর দিগন্তে বিস্তৃত হয়েছে। এটা আমার প্রথম উপলব্ধি। আমার দ্বিতীয় উপলব্ধি- দায়িত্ববোধ। আমার জনগণের চাহিদার প্রতি আমাকে এই দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করতে হয়েছিল। আমি নিজেকে সবসময় এমন একজন কবি হিসেবে আবিস্কার করেছি যার প্রতি অনেকের অনেক দাবি ছিল। এ ধরনের কবি হওয়ার কারণে আমার অনেক অনুযোগও ছিল। কিন্তু এবার আমার বিবেক ঐসব দাবির প্রতি আমাকে আলোড়িত করেছে। আমি উপলব্ধি করেছি, আমার উচিত তাদেরই একজন হয়ে থাকা। তারা যখন আমাকে ফুটবল মাঠে জড়ো হওয়া হাজারো মানুষের সামনে বক্তব্য দিতে অনুরোধ করলো, আমি বলেছিলাম বিগত ৪০ বছর ধরে বক্তব্য দেওয়াই আমার ক্যারিয়ারে পরিণত হয়েছে, কিন্তু আজকে এই মুহূর্তের জন্যে উপযুক্ত কোন বক্তব্য আমি খুঁজে পাচ্ছিনা। আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতি সত্বেও আমি তাদের মাঝে উপস্থিত ছিলাম- এই আপাত স্ববিরোধী অবস্থান প্রকাশ করা ছাড়া আমি আমি আর কিছুই বলতে পারিনি। আমি তাদের বলেছিলাম, ‘আমি কথা দিচ্ছি, আমি আপনাদের সাথে এখানেই থেকে যাব।’
নূরী আল জারাহ: যখন বুঝতে পারলেন আপনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি বাস্তব ঘটনা, তখন বলেছিলেন, ‘এতোটাই আনন্দিত হয়েছিলাম যে আমি নিজেকেই ঈর্ষা করছিলাম’। এই শব্দগুলো সৃষ্টির পেছনে কেমন অনুভূতি কাজ করেছিল?
মাহমুদ দারবিশ: আমি এমন এক নৈতিক শক্তি অর্জন করেছিলাম যা কিভাবে ব্যবহার করতে হবে আমার জানা ছিল না। আর এখন, এই ভ্রমণের পর, আমি এক মাস আগের মানুুষটি আর নেই। আমার মনে হচ্ছে, আমি সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনে প্রবেশ করছি। আমার সামনে চলাকে আমি এখন নতুন করে সাজাতে পারি, কারণ আমি ঠিক এই মুহূর্তে জন্ম নিয়েছি। জীবনের সবকিছুকে এখন আমি নতুন করে দেখছি। এই ভূমির জাদু আর জনগণের সৌন্দর্য আমার প্রত্যাবর্তনের উত্তেজনার সাথে মিশে আমাকে অবিভূত করেছে। আর তাই আমি বলবো, আমার জন্মসূত্রের সাথে নতুন করে পরিচিত হবার একটি সুযোগ ঘটেছে। এ ধরনের সুযোগ এর আগে আমার ভাগ্যে জোটেনি।
নূরী আল জারাহ: আপনি বলেছিলেনÑ একজন কবি নিজেকে নিয়ে তখনই বিভ্রান্তিতে পড়ে যখন সে নিজের মধ্যে এমন এক সূত্রের সন্ধান পায় যা এতোদিন অদৃশ্য ছিল এবং যাকে সে দৃশ্যমান করতে চায়। আপনি বলেছিলেনÑ কোন পৌরাণিক বীরপুরুষ নয়, কবিতায় আপনি সেই সব মানুষের কথা বলবেন যারা সাধারণ, বঞ্চিত ও ভীত। নিজ ভূ-খন্ডে প্রত্যাবর্তনের আবেশে আপনার মধ্যে এমন এক আকাঙ্খার সৃষ্টি হয়েছে যা যতোটুকু না ‘পৌরাণিক’ তারও চেয়ে বেশি ‘মানবিক’। কিন্তু কবিতায় এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে উপস্থাপন করবেন?
মাহমুদ দারবিশ: আমার এই মন্তব্যের মধ্যে দুটি স্তর আছে। প্রথমটি হল, কবিতা ও ভাষা তার যাত্রাবিন্দুতে প্রত্যাবর্তন করেছে। আর আমি যেন এক আদিম মানব রূপে মানবিক উপলব্ধি ও দৃষ্টিতে এই পৃথিবীটাকে প্রথমবারের মত দেখছি। আমি যেন ঠিক এই মুহূর্তে শূন্যতা থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছি। মানবিক স্তর সম্পর্কে এটাই আমার উপলব্ধি। আর নিজ অস্তিত্বের সাথে একজন আদিম মানবের প্রথম পরিচয়ের গল্প আমি অবশ্যই বর্ণনা করবো। অস্তিত্বের সাথে এ ধরনের সাক্ষাৎ বিস্ময়কর এক অনুভূতির জন্ম দেয় যা কবিতার জন্য প্রয়োজনীয়। কারণ সূচনা ছাড়া কোন কবিতা হয় না। ভাষা থেকে বিচ্যুত হলে কবিতা চিন্তায় রূপান্তরিত হয় এবং আবারো কবিতা হবার জন্য থমকে দাঁড়ায়।
আমার মন্তব্যের দ্বিতীয় স্তরটি হলো, আমাদের বেঁচে থাকার ঐতিহাসিক শর্তাবলী মানবতায় প্রত্যাবর্তন ও পুরাণ আশ্রয়ী না হয়ে আমাদের সাধারণ জীবন কাহিনী বর্ণনা করাকে অপরিহার্য করে তুলেছে। কারণ, শুধু আমাদের (আরব) কবিতাতেই নয়, কবিতায় পুরাণের ব্যবহার পুরো বিশ্বেই এখন শিখর স্পর্শী। এখন সাধারণ ও বঞ্চিত মানুষরাই সাহিত্যে কাহিনীর জন্ম দেয়। ধ্রুপদী চেতনায় বীরত্বের কোন স্থান নেই। এখন সেই ব্যক্তিই বীর যে তার অস্তিত্ব রক্ষা ও অভাব পূরণের হাতিয়ারের সন্ধান করে এবং নিজস্ব মানবিক চিন্তা-ভাবনার অনুরক্ত থাকে।
নূরী আল জারাহ: বাড়িতে কিভাবে প্রবেশ করলেন? আপনি কি ‘বিসমিল্লাহ্’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন? দরজার চৌকাঠ পেরুবার পরের স্মৃতি কি মনে আছে?
মাহমুদ দারবিশ: নিজের দুই পায়ে ভর দিয়ে আমি ঘরে ঢুকেছিলাম কিনা তা মনে নেই, তবে আমার হৃদয় দুরন্ত চঁড়–ইয়ের মত ছটফট করছিল। অসংখ্য আলিঙ্গন ঐ সময়ের সব স্মৃতিকে মুছে দিয়েছে। ঐ সময়ে অশ্র“ই ছিল আমার ভাষা। তবে মনে পড়ছে, আমি বলেছিলাম,‘তোমাকে ধন্যবাদ, ঈশ্বর’।
নূরী আল জারাহ: বাড়িতে কি কফি খেয়েছিলেন? কতটুকু খেয়েছিলেন? কে বানিয়ে দিয়েছিল, আপনার মা নাকি আপনি নিজেই?
মাহমুদ দারবিশ: হ্যাঁ, আমি আমার মায়ের দেয়া কফি খেয়েছিলাম। কে বানিয়েছিলÑ মা না তার সুন্দরি নাতনিদের কেউ, সেদিকে আমার মনোযোগ ছিল না। কফি খেয়ে সচরাচর আমি যে জগতে হারিয়ে যাই ঐ কফি আমাকে সেই জগতে নিয়ে যেতে পারেনি। তার বদলে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল দূর অতীতের কোন এক সময়ে। মা আমাকে আমার পুরনো পড়ার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন, সব কিছু আগের মতই ছিলÑ আমার স্কুলের বই, দেয়ালে টাঙ্গানো আমার ও বাবার ছবি, সবকিছু। আর সন্ধ্যায় ফাতিহা পাঠ করার জন্যে মা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবার কবরে। অতিথিদের সমাগম এতোটাই বেশি ছিল যে আমি মাকে খুব একটা সময় দিতে পারিনি, আর তিনিও আমার সবটুকু সময় এককভাবে দাবি করেননি। কোন এক দূর প্রান্ত থেকে তিনি তার সন্তানের প্রত্যাবর্তনকে অবলোকন করছিলেন। তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন, আমি এখন শুধুমাত্র তার সন্তান নই। বাড়ির উঠোনে পা দেবার পর তার সেই নিঃসংকোচ কান্নার ব্যাখ্যা এ ঘটনার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। উঠোনে আমাকে জড়িয়ে ধরে মা যখন কেঁদে ফেললেন তখন তিনি আমার নামের প্রথম অংশ উচ্চারণ করেননি। তিনি আমার পুরো নাম ধরে ডেকেছিলেন, তিনি উচ্চারণ করেছিলেনÑ মাহমুদ দারবিশ। আমার মনে হচ্ছিল, জনগণের জন্যে তিনি তার উপহারের নাম ঘোষণা করছেন।
নূরী আল জারাহ: হাজার হাজার গৃহত্যাগী আরব তরুণ-তরুণী দূর-দূরান্ত থেকে আপনার শব্দ ও সঙ্গীত ব্যবহার করে তাদের মায়ের কাছে বার্তা পাঠায়- ‘আমার মায়ের বানানো রুটি, কফি ও তার স্পর্শের জন্যে আমি ব্যাকুল হয়ে থাকি’। রেডিওতে যখন এ গানটি বাজানো হয় তখন মূলত তার বানানো কফির কথাই উচ্চারিত হয়Ñ আপনি কি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি এটা জানেন কিনা?
মাহমুদ দারবিশ: দুর্ভাগ্যবসত আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। কারণ ঐ মুহূর্র্তে গানটি তার উৎস-স্থলে ফিরে গিয়েছিল। আমি তখন সমস্ত অনুভূতি নিয়ে অন্য অনুভূতির মধ্যে মিশে গিয়েছিলাম। সুতরাং, নস্টালজিয়া, শব্দ, কবিতা এসবের কী প্রয়োজন? সাহিত্য থেকে সাময়িক মুক্তির লঘুত্ব আমি কম-বেশি উপলব্ধি করেছিলাম। যেহেতু লেখালেখি থেকে ঐ মুহূর্তে আমি মুক্ত ছিলাম, তাই মাকে আমি অন্য একটি প্রশ্ন করেছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম: ‘মা! ছোট বেলায় তুমি আমাকে এতো মারতে কেন?’
নূরী আল জারাহ: কিছু সুনির্দিষ্ট শর্ত না মানলে আইনগতভাবে আপনি আল কারমেলে আপনার বাড়িতে থাকতে পারবেন না। ইসরাইলিদের যেমন শর্ত আছে, তেমনি আপনারও কিছু শর্ত আছে। আর খুব সম্ভবত শর্তগুলোর মধ্যে যথেষ্ট বৈপরীত্যও আছে। কিভাবে এই জটিলতার সমাধান করবেন?
মাহমুদ দারবিশ: আইনী ও রাজনৈতিক শর্ত থেকে আমি এখন অনেক দূরে। কারণ আমি এখন যে কথাগুলো বলছি তা আবেগ ও রূপকের শক্তি দিয়ে বলছি। আমার মনে হচ্ছে, এই ভূমি আমি ত্যাগ করিনি এবং আমি এখানেই থেকে যাব। এই মুহূর্তে এই ভূমির সাথে আমার দূরত্বÑ আমার সাথে আমার সত্তার দূরত্ব এবং আমার সত্তার সাথে আমার ভাষা ও অনুভূতির দূরত্বের সমান। তবে কবিতা ছাড়া এই ক্ষেত্র ততোটা অবারিত নয়। আমরা যখন বাস্তব ক্ষেত্রে প্রবেশ করবো তখন আপনার প্রশ্ন সঙ্গত হবে। কারণ, আমার এই প্রত্যাবর্তন আনুষ্ঠানিক কিংবা বৈধ কিংবা বাস্তব ঘটনা নয়। এটা এক ধরনের নৈতিক প্রত্যাবর্তন। আর কয়েক ঘন্টা স্থায়ী এই প্রত্যাবর্তনকে বাস্তবতার মানদন্ডে নিরূপন করা হয়েছে মাত্র। আমার প্রকৃত প্রত্যাবর্তন এখনো অর্জন করা সম্ভব হয়নি এবং সেটা নিয়ে আলোচনাও হয়নি।
নূরী আল জারাহ: আপনি এই বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?
মাহমুদ দারবিশ: যে আনন্দে আমি আজ আত্মহারা, সে আনন্দই আমাকে এই সব রাজনৈতিক ও আইনী শর্তগুলো যাচাই-বাছাই করা থেকে বিরত রেখেছে। তবে আমি স্বীকার করছি, বহু বছর পর আমি আবার আশাবাদী হয়ে উঠেছি। তবে এ আশাই আবার আমাকে নিরাশার সতর্কবাণী শুনাচ্ছে। কারণ, আমি অনুভব করছি, আমাদের সামনে এক নয়া জগত উন্মোচিত হচ্ছে। আর অতীত নিয়ে আমার অব্যাহত কর্মকান্ড ভবিষ্যতের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে যাইহোক, ইসরাইলিরা যদি কোন শর্ত আরোপ করে তখন আমারও অধিকার আছে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান করার। তবে বর্তমানে এ ধরণের কোন পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। যে আনন্দের শক্তিতে আমি আন্দোলিত হচ্ছি সেই আনন্দই এই অনন্ত মহাবিশ্বে ঐ ধরনের দৃশ্যের দুয়ার উন্মোচন করছে।
নূরী আল জারাহ: ‘রীতার লোককাহিনী’Ñ তে আপনি যেসব বন্ধু ও পরিচিত জনের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের কেউ কি এই ‘প্রত্যাবর্তন’ এর পর অভিনন্দন জানাতে আপনার সাথে দেখা করেছিল?
মাহমুদ দারবিশ: হ্যাঁ, করেছিল। আপনি জানেন যে, আমি ফিলিস্তিনে গিয়েছিলাম এক উদ্দেশ্যে, অথচ নিজেকে আবিস্কার করেছিলাম অন্য এক পরিস্থিতির মধ্যে। আমি নিজেই এমিলি হাবিবির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার নিজ জীবন ও সৃষ্টিশীলতার উপর নির্মিতব্য একটি চলচ্চিত্রের অংশ হিসেবে মাউন্ট কারমেলের পুরনো বাড়িতে সে একটা বৈঠকের আয়োজন করেছিল। একটা সময় ছিল যখন আমি ঐ বাড়িতে থাকতাম। এই বৈঠক আয়োজন করতে তাকে প্রচুর কাঠ-খর পুড়াতে হয়েছে। আমাদের কথোপকথনের দৃশ্য যাতে ক্যামারাবন্দী করা যায় সে জন্য চলচ্চিত্রটি শেষ করতে আমার প্রত্যাবর্তনের সময় পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যদিও আমি তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু লক্ষ্য করলাম আমি মূলত তাকে বিদায় জানাচ্ছি এবং শোকাচ্ছন্ন করে তুলছি। ঐ বাড়িতে এমিলি হাবিবের পাশে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রখ্যাত সব ইহুদি ও আরব ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে পুরনো সব বন্ধুদের পেয়েছিলাম; বিশেষকরে বুদ্ধিজীবী, লেখক, কবি, এমনকি রাজনীতিবিদ বন্ধুদেরও। অনেকের সাথেই আমাকে হ্যান্ডশেক করতে হয়েছিল, যদিও এটা কোন আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছিল না। ইসরাইলি মন্ত্রী ইয়োসি সারিদের সাথে পরিচয় না থাকলেও তিনি আমার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছিলেন। তবে আমার প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গ নিয়ে তার সাথে কোন আলোচনা হয়নি।
নূরী আল জারাহ: অভিবাসী ফিলিস্তিনিদের নিয়ে আমেরিকাতে একটা সম্মেলন আয়োজনের কাজ চলছে। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসাম শারাবির কাজ থেকে এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত জেনেছি। এ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য হল, প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন অভিবাসী ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় আরব ও ফিলিস্তিনি আলোচকদের উপর চাপ প্রয়োগ করা। কারণ আয়োজকরা মনে করেন, বর্তমান শান্তি প্রক্রিয়ার কারণে তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তারা এও মনে করেন যে, বিশ্বের প্রতিটি অভিবাসী ফিলিস্তিনির প্রতিনিধিত্ব এই সম্মেলনে থাকবে। এই সম্মেলন নিয়ে আপনার মনোভাব কেমন?
মাহমুদ দারবিশ: কোন সন্দেহ নেই, ঐক্যবদ্ধ প্রতিনিধিত্ব অটুট রাখতে অভিবাসী ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক যুক্তি-তর্ক নতুন করে সূত্রাবদ্ধ করতে হবে। কারণ ফিলিস্তিন ভূখন্ড, ফিলিস্তিনের ন্যায্য দাবি ও স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীগুলো বিভক্ত হয়ে পড়লে তার কিছু বাস্তব বিপদ দেখা দেবে। ফিলিস্তিনে বসবাসরত প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর সমস্যার ধরন যেমন আলাদা, তেমনি সেগুলোর সমাধানও পরস্পর সম্পর্কহীন। সুতরাং, নিজেদের ভাগ্য নিয়ে অভিবাসী ফিলিস্তিনিদের যে কোন চিন্তা ও ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবে এর জন্য নতুন কোন প্লাটফর্ম সৃষ্টির প্রয়োজন নেই। এখন পর্যন্ত পিএলও-ই সকল ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধি এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এ সংস্থাই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করে আসছে।
নূরী আল জারাহ: ঘোষণা পত্র থেকে বেশ কিছু মূলনীতি বাদ দেবার পরও?
মাহমুদ দারবিশ: হ্যাঁ, তা সত্বেও। কারণ এখন পর্যন্ত নতুন কোন ফোরাম কিংবা ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নতুন কোন পদবীও সৃষ্টি হয়নি। আর তাই বুদ্ধিবৃত্তিক, জাতীয় ও নৈতিক প্রয়োজনে অভিবাসী ফিলিস্তিনিদের উচিত নিজস্ব চিন্তার সাথে সাথে ফিলিস্তিনি সমাজ, আন্দোলন ও ভূখন্ডের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। এই সম্মেলন সংক্রান্ত খবর আমি প্রত্রিকায় পড়েছি, এ ধরনের সম্মেলনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমি কিছুটা চিন্তিত। কারণ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ থাকা উচিত এবং লক্ষ্য রাখা উচিত, ফিলিস্তিনের রঙধুনুতে যে কয়টি রঙ আছে তার কোনটিই যেন এ সম্মেলন থেকে বাদ না পরে। আমাদের অবশ্যই সংকীর্ন মানসিকতা পরিহার করতে হবে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, এ বিষয়ে কেউ আমার সাথে কথা বলেনি। আমি যতোটুকু জেনেছি তা সংবাদপত্র থেকে। সে যাইহোক, এ ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য। এই সম্মেলন মূলত ফিলিস্তিনি আলোচক ও মধ্যস্থতাকারীদের সমর্থন যোগাবে। কারণ আমরা এখন পর্যন্ত শান্তির প্রকৃত মহাসড়কে উঠতে পারিনি; অলিগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছি মাত্র।
ফিলিস্তিনিদের মূল দাবিগুলো এখন পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে উত্থাপনই করা হয়নি। ফিলিস্তিনিদের একটি পা ফেলবার জায়গা প্রয়োজন; যাকে আমি বলে থাকি ‘মাতৃভূমির উঠান’। বহু আগে থেকেই এ ধরনের একটি স্থান সৃষ্টির দাবি মূল দাবিগুলোর সাথে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। শুধু এটিই নয়, নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের অধিকার, উদ্বাস্তু সমস্যা, জেরুজালেম ও ইহুদি বসতীস্থাপন এর মত প্রধান সমস্যাগুলোও এখন পর্যন্ত আলোচনায় আসেনি। তাই সব ফিলিস্তিনিদের উচিত প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকা নিয়ে এই দাবিগুলোর পেছনে কাতারবদ্ধ হওয়া এবং ফিলিস্তিনি শান্তি প্রক্রিয়াকে আরব-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত করা। কারণ, আরবদের সহযোগিতা ছাড়া সামনে চলতে চাইলে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করা ইসরাইলের জন্য সহজ হবে। শান্তি প্রক্রিয়াকে আরবদের সাথে সংযুক্ত করা মোটেই বিপদজনক নয়, কারণ আমরা প্রায়ই বৃহত্তর আরব ঐক্যের কথা বলে থাকি। ফিলিস্তিনি শান্তি প্রক্রিয়াকে আরব-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে স¤পৃক্ত করা আমার দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় এবং খুব জরুরী বলেই মনে হয়।
নূরী আল জারাহ: আপনি কি মনে করেন, চলমান সমস্যা দূরীকরণে ফিলিস্তিনি মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট হয়ে কিংবা মধ্যস্থতা কার্যক্রম থেকে কিছু নেতৃস্থানীয় অভিবাসী ফিলিস্তিনিকে বাদ দেবার প্রতিক্রিয়ায় এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে? নাকি পিলও’র বাইরে নতুন কোন প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন সৃষ্টি করতেই এ সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে?
মাহমুদ দারবিশ: অভিবাসী ফিলিস্তিনিরা প্রথমে মনে করেছিল, শান্তি প্রক্রিয়াতে তাদের কোন অংশীদারিত্ব নেই। এ ধারণা থেকেই তারা নিজস্ব রাজনৈতিক যুক্তিকে সুসংহত করার উদ্যোগ নেয়। তবে যাইহোক, সম্পর্ক ছেদ করার আগেই পিএলও’র সাথে তাদের আলোচনায় বসা উচিত। এ ধরণের আলোচনা অবশ্যই নতুন কোন সংগঠন সৃষ্টির পূর্বেই হতে হবে। আর আমার মতে, বর্তমান অবস্থায় এ ধরনের উদ্যোগকে সাংগঠনিক অবয়ব দেবার চাইতে বুদ্ধিবৃত্তিক অবয়ব দেয়াটাই বেশি যুক্তিসংগত হবে। কারণ ফিলিস্তিন পরিস্থিতি এতোটাই ভঙ্গুর যে, কোন বিরুদ্ধবাদী সংগঠনকে সহ্য করার ক্ষমতা এর নেই।
নূরী আল জারাহ: ইয়াসির আরাফাতের উদ্দেশ্যে আপনি কী বলবেন, যিনি মাত্র কিছু দিন আগে আপনাকে সাথে নিয়ে প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথোরিটির বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন?
মাহমুদ দারবিশ: তাঁর উদ্দেশ্যে আমি বলবো, ‘ঈশ্বর আপনাকে সাহায্য করবেন এবং আলোচনার শেষ ধাপগুলো মোকাবেলা করার শক্তি যোগাবেন।’ পা ফেলবার একটি স্থান অর্জনের মধ্য দিয়ে আলোচনার প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছে। আর এখন শুরু হয়েছে ভবিষ্যতের জন্য ভাবমূর্তি সৃষ্টি ও অধিকতর জটিল সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার পর্যায়। যার জন্য প্রয়োজন পৌরাণিক ধৈর্য, সৃজনশীলতা এবং সুদৃঢ় ও বিস্তৃত রাজনৈতিক কল্পনাশক্তি।
নূরী আল জারাহ: শান্তি প্রক্রিয়ায় এডওয়ার্ড সাইদের অবস্থান সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
মাহমুদ দারবিশ: এডওয়ার্ড সাইদের মত বলিষ্ঠ বুদ্ধি বৃত্তিক অবস্থান আমাদের প্রয়োজন। কারণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের উচিত সব সময় নীতিবোধের অভিভাবক হয়েই থাকা। গোঁড়ামী কিংবা কোন নীতি বর্জিত রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশীদার হওয়া তাঁদের জন্য সঠিক নয়। ফিলিস্তিনি সমাজ ও চেতনায় এডওয়ার্ড সাইদের অবস্থান জটিল, মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ আর তাই তাঁর এই অবস্থানকে আমি স্যালুট করি। সর্বাবস্থায় বুদ্ধিজীবীরা হবেন স্বাপ্নিক ও দ্রষ্টা। গোঁড়া, নীতিবর্জিত ও স্বপ্নহীন হওয়া তাঁদের মানায় না।
নূরী আল জারাহ: কিন্তু আপনি বলেছিলেন, আমরা এখন বদলে গেছি, দখলদারদের সময় শেষ হয়ে গেছে। আমরা এখন যা পারি তা হলো, দখলদারদের কাছে পরাজিত হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করা। এটা কি মানবিক অনুভূতির সেই শক্তি, যা শেষ মুহূর্তে এই অসঙ্গতি কিংবা তুলোনার ফলাফল নির্ধারণ করে?
মাহমুদ দারবিশ: সমকালীন সমস্যা হচ্ছে, আমরা দখলদার হতে পারিনি, যদিও আমরা তাদের ভাষাতেই কথা বলি। কিন্তু দখলদারিত্বের তরবারি অন্যপক্ষ ঠিকই বহন করেছে।
নূরী আল জারাহ: ১৯৪৮ সালের ফিলিস্তিন অঞ্চলের বুদ্ধিজীবী এবং গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে বসবাসরত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কোন পার্থক্য কি আপনার চোখে পড়ে? এই দুই গ্র“পের মিল-অমিলগুলো কী কী?
মাহমুদ দারবিশ: বাস্তবতা হলো, সাংস্কৃতিক কিংবা জাতীয়তাবাদী ইস্যুগুলো এ পার্থক্যের মধ্যে পরে না। এই ভ্রমণের সময় বিভিন্ন প্রসঙ্গে দীর্ঘ সময় নিয়ে শতাধীক বুদ্ধিজীবীর সাথে আমার আলোচনা হয়েছে। যে বিষয়টি আমার দৃষ্টি কেড়েছে তা হলো, দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশে ভিন্নতা থাকলেও আমাদের আলোচনা একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছিল: ‘আমরা এখন থেকে কী লিখব?’ অবশ্য এই প্রশ্নে আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, আমরা অবশ্যই লিখব, আমাদের লেখালেখি অব্যাহত থাকবে এবং আমরা সাহিত্যের সেই ধারাকে বজায় রাখবো যার সাথে সাধারণ মানুষের কাহিনী, তাদের অস্তিত্ব, তাদের জগৎ এবং বাস্তব ও বিমূর্ত প্রশ্নগুলো জড়িত। যে কোন রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে আমরা আরবরা সাধারণত প্রশ্ন তুলি, ‘আমাদের সাহিত্যের ভবিষ্যত কী?’ এ ধরণের প্রশ্নে আমাদের সাহিত্যিক চেতনা ও প্রকৃতির সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন ঘটে। কারণ পৃথিবীর আর কোন জাতি সাধারণত এ প্রশ্ন করেনা যে, ‘আমরা এখন শান্তি কিংবা যুদ্ধে উপনীত হয়েছি, সুতরাং আমরা এখন কী করবো?’ অবশ্য একটি স্বতন্ত্র ভাষার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব এবং তার আচরণে ভিন্নতা থাকাও স্বাভাবিক। তবে মানুষের জীবনের গল্প বলবার জন্য সাহিত্যের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে।
নূরী আল জারাহ: তারপরও ঐ একই প্রশ্ন আরো সুনির্দিষ্টভাবে করতে চাই: ‘এখন আপনি কী লিখছেন, আর এখন থেকে আপনি কী ধরনের লেখা লিখবেন?’ এটা সুস্পষ্ট যে এই ভ্রমণ আপনাকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে।
মাহমুদ দারবিশ: দীর্ঘ সময় ধরে আমি আমার কাব্য প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছি এবং ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক অগ্রগতির সাথে এর কোন যান্ত্রিক সম্পর্ক নেই। আমি বুঝতে পারছি, আমার ভাষা যান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত হয়েছে, আর আমি ক্রমাগত নিত্যদিনের চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আপনি যদি জানতে চান আমি কী লিখছি, তবে বলবো, আমি প্রেম ও ভালোবাসা নিয়ে একটি বই লিখছি।
নূরী আল জারাহ: আপনি বলেছেন, নিত্যদিনকার চাপ থেকে আপনার ভাষা মুক্ত হচ্ছে। মুক্তির এই নান্দনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নির্বাসন বিষয়টি সুতার মত প্রবাহিত হয়েছে। যা রাজনৈতিক বিষয়গুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে আপনার জীবন ও লেখার মধ্যে সেগুলোকে প্রবেশ করার সুযোগ করে দিয়েছে।
মাহমুদ দারবিশ: নির্বাসনের বিরুদ্ধে আমি কোন অভিযোগ করতে পারি না। কারণ নির্বাসন আমার জন্য সহৃদয় ও শিক্ষনীয় হয়েছে। নির্বাসন আমাকে সংস্কৃতির সন্ধান দিয়েছে, আমার মানবিক ও ভাষার পরিসরকে আরো বিস্তৃত করেছে এবং আমার কবিতায় মানুষ ও সংস্কৃতির সংলাপ যুক্ত করার সামর্থ্য জুগিয়েছে। আমি নির্বাসনকে পরিত্যাগ করতে পারিনা, কারণ নির্বাসন আমার একটি মৌলিক উপাদান। এমনকি যদি আমি এখন হাইফা ও একর-এ ফিরে যাই এবং বসবাস করা শুরু করি তারপরও আমার ভেতরকার নির্বাসন, যা একটি বৃহৎ মানবিক নির্বাসন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, আমার সবচেয়ে মূল্যবান মানবিক অবস্থা হয়েই থাকবে। চুড়ান্ত বিচারে নির্বাসন আমার কাছে একটি আপেক্ষিক বিষয়, কারণ আমার মাতৃভূমিতেও এর চাইতে বৃহৎ পরিসরে নির্বাসনের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।
নূরী আল জারাহ: আপনার দৃষ্টিতে ফিলিস্তিনের সৃজনশীল সাহিত্য ধারায় নতুন কিছু যুক্ত হয়েছে কি?
মাহমুদ দারবিশ: ফিলিস্তিনি সাহিত্যে নতুন কোন সংযোজন আছে কিনা সে বিষয়ে অবহিত হবার সুযোগ ঐ সংক্ষিপ্ত সময়ে আমি পাইনি। মাতৃভূমির সাথে ব্যক্তি মানুষের সম্পর্কের প্রকৃতি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে, তাই আমি এ বিষয়টিই অনুসন্ধান করেছি। আমি বিশ্বাস করি, সৃজনশীলদের উচিত এমন এক ভাষায় এই সম্পর্কের কথা লেখা যা ধ্র“পদী চেতনায় দেশাত্ববোধক নয়, অথচ সংগ্রামের ধারণা সূচিত করে। দেশ ও দেশের বাইরের সেই সব ফিলিস্তিনি কন্ঠস্বরের প্রতি আমি বেশি মনোযোগী যারা এই প্রবণতাকে অনুসরণ করে। প্রবীণ কবি ও লেখকরা নতুন প্রজন্মকে আরো বৃহত্তর ঐতিহাসিক ক্ষেত্র ও বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। যা ফিলিস্তিনিদের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় শক্তিশালী করার জন্য ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজন ছিল। নতুন প্রজন্ম এখন ইচ্ছে করলেই সে সব ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে যা একই সাথে আরো বেশি অন্তরঙ্গ ও মানবিক। কারণ তাদের পূর্বপুরুষরা সাহিত্যে ‘দেশাত্মবোধক দায়িত্ব’ পালন করে গেছে।
নূরী আল জারাহ: ফিলিস্তিনে ফিরে গিয়ে আপনি কোন কাজটি করেননি, আর কোন কাজটি অসমাপ্ত রয়ে যাবার জন্যে আপনি অনুতপ্ত?
মাহমুদ দারবিশ: আমি আমার প্রথম গ্রাম আল বিরওয়াহতে যেতে সক্ষম হয়নি এবং পুরনো সেই কুয়োর পারে ক্ষণিকের জন্যও বসতে পারিনি। আমি আমার পুরনো স্কুলেও যেতে পারিনি। শুধু তাই নয়, আমি সেই সব অলি-গলি, সড়ক ও দৃশ্যগুলো দেখতে পারিনি যেগুলো আমার ভাবমূর্তির অভিধান রচনা করেছে।
নূরী আল জারাহ: ফির্লিস্তিন থেকে জর্ডানের এই স্থানে ফিরে আসবার পর আপনার কি মনে হচ্ছে, এক ধরনের মানবিক-অলৌকিক শক্তি বলেই ফিলিস্তিনি জনগণ এখনো টিকে আছে? https://bklit.wordpress.com
মাহমুদ দারবিশ: এটি সত্যিই এক অলৌকিক ঘটনা এবং এর উৎস সাধারণ মানুষ। আর এই অলৌকিকতার রূপায়ন ঘটেছে সাধারণ মানুষের ভূমি, ইতিহাস ও স্মৃতি রক্ষার সামর্থ্যরে বহিঃপ্রকাশ দ্বারা। আমি স্বীকার না করে পারছিনা, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় আরব স্বাতন্ত্রই এই জনগোষ্ঠীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছে। ফিলিস্তিনিরা একটি বৃহৎ ও সুদৃঢ় জাতির অংশ এবং তারা একাধিক মহাদেশে ছড়িয়ে আছে। এই বাস্তবতাই তাদেরকে সাংস্কৃতিক বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করেছে।
Post a Comment