ঘটনাটি ঘটে ফেব্রুয়ারী মাসের কোনও
এক শুক্রবারে। তারিখ মনে নেই।
আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
মাঝে মাঝে কাজ শেষে বাসায়
ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়।
কখনো কখনো রাত ২ টাও বেজে যায়।
আমরা মেইনলি ফরেন কোম্পানিগুলোর
সাথে ডিল করি। তাই অনেক সময়
কাজের প্রেসার বেশি থাকলে যত
রাতই হোক, কাজ শেষ
করে বাড়ি ফিরতে হয়।
এমনি ভাবে একদিন রাত ২ টার
দিকে অফিস থেকে বের হয়েছি। মনটা
অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক
বেশি ভালো ছিল।
আজকে বিকেলে শুনেছিলাম আমার
প্রমোশন হতে যাচ্ছে। অনেকদিনের
একটানা খাটাখাটনির ফল
পেতে যাচ্ছি। যারপরনাই উৎফুল্ল। যাই
হোক, অফিস থেকে বের
হয়ে কিছুটা সামনে এগুলেই একটা মোড়
পড়ে। এখানে যত রাতই হোক, সি এন
জি অবশ্যই পাওয়া যায়। কৃষ্ণপক্ষ
দেখে কিনা জানি না, কিন্তু আকাশ
আজ বেজায় কালো। শীতের দাপট
কমেছে ঠিকই, কিন্তু এখনও
রাত্রিবেলা ভারী পোশাক
গায়ে দিয়ে হাঁটতে হয়। শার্টের উপর
একটা চাদর চাপিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। আশ্চর্য
লাগলো। প্রায় ১৫ মিনিট
ধরে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু সি এন
জি তো দূরের কথা, কোনও মানুষ পর্যন্ত
চোখে পড়লো না।
টেনশনে পড়ে গেলাম। সিগারেট
খাওয়ার অভ্যাসটা প্রায় চলে গেছে।
কিন্তু কেন যেনও এই
টেনশনে একটা সিগারেট
ধরাতে ইচ্ছে করল। ব্যাগ
হাতড়ে কয়েকদিন আগের
একটা দুমড়ানো সিগারেটের প্যাকেট
বের করলাম। কপাল ভালো,
সাথে ম্যাচটাও পেলাম। বুক ভোরে দম
নিতেই দেখলাম
টিং টিং করতে করতে একটা রিকশা আসছে।
রিকশাওয়ালা শীতে কাবু
হয়ে গেছে যেনও! কোমর পর্যন্ত
সাদা চাদর দিয়ে মুড়ানো।
সাদা রঙটা কেন যেনও চোখে লাগছে।
এতো সাদা রঙ সচারচর দেখা যায় না।
রাস্তার পাশের নিয়ন আলোয়ও স্পষ্ট
ঝিক ঝিক করতে দেখলাম চাদরটা।
রিকশাওয়ালা আমার
হাতনাড়া দেখে আমার প্রায় পায়ের
কাছে এনে রিকশা থামাল। কমলাপুর
যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। ঘাড়
নেড়ে বলল যাবে। জিজ্ঞেস করলাম কত
দিতে হবে। কিছু বলল না। পুনরায়
জিজ্ঞেস করলাম। এবার একটু চড়া গলায়।
চাদরের ফাঁক দিয়ে মাথা বের
করে আমার দিকে তাকাল সে।
রিকশাটা রাস্তা থেকে ভালো দূরেই
থেমেছিল। আলো কম থাকায়
মুখখানি ভালো ভাবে দৃষ্টি গোচর হল
না। তবে যা দেখলাম,
তা ভড়কে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
মুখ ভর্তি গর্ত গর্ত দাগ। আগের দিনে পক্স/
গুটিবসন্ত হলে নাকি মানুষের এমন দাগ
হতো। কিন্তু লোকটার বয়স খুব
বেশি বলে মনে হল না। ভাঙ্গা,
খসখসে গলায় বলল, ৩০ টাকা দিয়েন।
এমনিতেই রাত্রি প্রায় আড়াইটা, তার
উপর রাস্তা পুরো ফাঁকা। দিনের
বেলায় এই রাস্তায় ৩০ টাকায়
রিকশা পাওয়া দুর্লভ। ব্যাটার অন্য কিছু
মতলব আছে কিনা বুঝতে চেষ্টা করলাম।
দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাসায়
ফেরা দরকার। অগত্যা উঠে বসলাম।
রিকশা ধীর গতিতে এগুতে লাগলো।
ফাঁকা রাস্তা, চাইলেই ঝড়ের
বেগে চালানো যায়, তা না করে এমন
ধীর ভাবে চালানোর কোনও মানে হয়?
পেছন থেকে অস্থির গলায় বললাম, একটু
জোড়ে টানো।
কথাটা সে কানে তুলল
নাকি বুঝা গেলো না। রিকশার
গতি তেমনই রইলো। রেগে ঘাঁট
মেরে বসে রইলাম। রাত বেশি বলে,
নইলে নির্ঘাত ব্যাটার
কপালে খারাবি ছিল।
হটাত
আমাকে চমকে দিয়ে রিকশাওয়ালা বলে উঠলো,
দিনের বেলা হইলে আমারে পাইতেন
না। মারতেন কেমনে?
কিছুক্ষণের জন্য থ মেরে গেলাম।
বুঝতে চেষ্টা করলাম আসলেই কিছু
শুনেছি কিনা। নাকি আমার অস্থির
মনের উল্টাপাল্টা কল্পনা।
রিকশাওয়ালা ভয়ঙ্কর
ভাবে হেসে উঠলো। বলল, কল্পনা না।
আপনি ঠিকই শুনছেন!
হৃৎপিণ্ডটা ধিম ধিম করে হাতুরির মত
পিটাচ্ছিল। যেকোনো মুহূর্তে যেনও
গলা দিয়ে বের হয়ে আসবে। বহু কষ্টে,
সমস্ত শক্তি এক করে বললাম, তুমি কে?
লোকটা আবারো একটা ভয়ঙ্কর
পিলে চমকানো হাসি দিয়ে বলল,
ঘাবড়ায়ইয়েন না। আপনার কোনও
ক্ষতি করবো না!
শীতের মধ্যেও আমার কানের
নিচে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল।
জীবনে প্রথমবারের মত এমন কোনও
পরিস্থিতিতে পড়েছি। একমনে
আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। যত
রকমের দোয়া দরুদ শিখেছিলাম, একের
পর এক পড়তে লাগলাম।
রাস্তা প্রায় শেষ, আর কিছুটা পথ
এগুলেই আমাদের বাসার সামনের
রাস্তায় এসে যাবো।
রিকশা আচমকা ব্রেক
করে থেমে গেলো। কর্কশ গলায় বলল,
নামুন!
আমি লাফ
দিয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়লাম।
দৌড়
দিবো নাকি দাঁড়িয়ে থাকবো মনস্থির
করতে পারছিলাম না। কোথায় যেনও
শুনেছিলাম, এদের অপমান করতে নেই।
দাঁড়িয়ে থাকবো ঠিক করলাম।
মাথা নিচু করে মানিব্যাগ বের করলাম।
ব্যাটা থেমেছে তো থেমেছে একদম
অন্ধকারে এসে থেমেছে।
মানিব্যাগে আলো ঢুকছে না। সাহস
করে পকেট
থেকে নোকিয়া ফোনটা বের করলাম।
টর্চ লাইট মোবাইল। আলো ফেললাম
মানিব্যাগে। টাকা বের করে যেই
দিতে যাবো,
অমনি আলোটা ঘুরে লোকটার মুখের উপর
পড়লো।
শুধু একটুকরো কঙ্কাল। শরীরের
অংশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
কোঠরে চোখ নেই। নাকের জায়গায়
দুটো ফুটো। ভয়ে মুখ দিয়ে এমনিতেই
চিৎকার বেরিয়ে গেলো। আমার ভয়
পাওয়া দেখে সেটি আকাশ বাতাস
কাঁপিয়ে কর্কশ গলায় হেসে উঠলো।
অবশেষে নিজের মনশক্তির উপর কন্ট্রোল
হারালাম। জ্ঞান
হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে আমার
মা-বাবার রুমে।
আমাকে ঘিরে উৎকণ্ঠি মানুষের ঢল
দেখতে পেলাম।
পরবর্তীতে জেনেছিলাম,
আমাকে নাকি অফিসের বাইরের সেই
মোড়ে সকালে ঝাড়ু
দিতে এসে পড়ে থাকতে দেখে সিটি কর্পরেশনের
লোকেরা।
ছিনতাইকারী ধরে মেরে তেরে ফেলল
নাকি ভেবে আমাকে দ্রুত উদ্ধার
করে হাসপাতালে ভর্তি করে তারা।
মারাত্মক কোনও
সমস্যা না খুঁজে পাওয়ায় সেখান
থেকে আমাকে রিলিজ করা হয়। তারপর
উনারা আমাকে বাসায় নিয়ে আসেন।
চোখ খুলেই গতরাতের
ঘটনা মনে পড়ে গেলো। মা-বাবার শত
বাঁধা অমান্য করে ছুটে গেলাম আমার
ঘরে। টেবিলের উপর আমার
মানিব্যাগটা দেখতে পেলাম।
তড়িঘড়ি করে খুলে ফেললাম।
খুচরো টাকা যেই পকেটে রাখি সেই
পকেটে সব টাকাই দেখতে পেলাম।
এমনকি ৫ টাকার দুটো কয়েন এবং ২
টাকার তিনটি নোট সবই ছিল। ক্যাশ
টাকা যেমন যা ছিল তেমনি আছে। শুধু
খুঁজে পেলাম না একটি ২০ টাকার আর
একটি ১০ টাকার নোট
Post a Comment